- আবু নাবিল
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে পরাবাস্তব কবিতা (Surreal Poetry) একটি বিশেষ শিল্পধারা, যেখানে বাস্তব ও অবাস্তবের মিশ্রণ, হঠাৎ দৃশ্যান্তর এবং প্রতীকী অস্পষ্টতার মাধ্যমে কবি পাঠককে স্বপ্নের মতো এক অভিজ্ঞতায় নিয়ে যান। শাহাদাতুর রহমান সোহেলের "একটি দোলনা দুলতে থাকে" কবিতাটি এই ধারার একটি সফল উদাহরণ। এটি একটি শংকর গদ্য কবিতা, যেখানে মিল ও অমিল, ছন্দ ও মুক্ত গতি, পবিত্রতা ও অশুভ—সব একসাথে মিশে গেছে।
কবিতার গঠন ও শৈলী
কবিতাটি গদ্যের স্বচ্ছন্দ প্রবাহ বজায় রেখেও ছন্দময় মুহূর্ত তৈরি করে।
-
দ্রুত দৃশ্যান্তর: দোলনার দোলন থেকে মধু আহরণ, তারপর ট্যারান্টুলা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, শিশু, গোলাপ, জীন, স্বর্গদূত, মৌমাছি—প্রতিটি চিত্র পাঠককে এক মানসিক ভ্রমণে নিয়ে যায়।
-
দ্বৈততা: শেষ লাইন "শুদ্ধ ও ভুল"–এর মতো, পুরো কবিতায়ই দ্বৈততার উপস্থিতি প্রবল—সুখের সাথে বিপদ, সৌন্দর্যের সাথে ক্ষয়, পবিত্রতার সাথে অশুভ।
-
প্রতীক ও উপমা: প্রতিটি চিত্র বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে, যা সরাসরি নয়, বরং পাঠকের চিন্তায় বিস্তার লাভ করে।
- শিল্পের নতুন নিরীক্ষা: শংকর গদ্য কবিতা:কবিতাটির আঙ্গিক বা ফর্ম নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। কবি নিজেই এটিকে "শংকর গদ্য কবিতা" হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেখানে মিল ও অমিলের এক শৈল্পিক মিশ্রণ ঘটেছে। এই ফর্মটি কবিতার বিষয়বস্তুর সাথেও অত্যন্ত মানানসই। পরাবাস্তবতার মূল কথাই হলো বাঁধাধরা নিয়মকে অস্বীকার করা। তাই কবিতার আঙ্গিকও এখানে প্রথাগত ছন্দের কাঠামো ভেঙে গদ্যের মুক্ত আঙ্গিকে প্রবেশ করেছে, যা বিষয়বস্তুর বিক্ষিপ্ততাকে ধারণ করতে সাহায্য করেছে।
প্রতীকী বিশ্লেষণ
কবিতার প্রধান চিত্র ও প্রতীকগুলোকে কয়েকটি থিমে ভাগ করা যায়:
১. সময় ও জীবনের দোদুল্যমানতা
দোলনা এখানে সময়, শৈশব এবং অনিশ্চয়তার প্রতীক। এটি জীবনের অবিরাম গতিশীলতা ও দ্বিধার চিত্র বহন করে।
২. সুখ ও বিপদের সহাবস্থান
মধু আহরণ জীবনের মধুর অভিজ্ঞতার প্রতীক হলেও, এর সাথে ট্যারান্টুলার বিষের তুলনা সুখের মাঝেও লুকানো যন্ত্রণার উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩. প্রকৃতির নির্মমতা ও নিরপরাধের বিপদ
বাঘ, কুমির এবং অসহায় হরিণ শাবক—এখানে শক্তি ও দুর্বলতার চিরন্তন সংঘাত ফুটে উঠেছে।
৪. সৌন্দর্য ও অন্তর্লীন ক্ষয়
গোলাপ ও তার অন্তরের কীট—এটি বোঝায় যে বাহ্যিক সৌন্দর্যের ভেতরে ক্ষয়ের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে।
৫. শুভ ও অশুভ শক্তির লড়াই
দুষ্ট জীন ও স্বর্গদূত—অদৃশ্য জগতের শুভ-অশুভ দ্বন্দ্বের প্রতীক।
৬. আধ্যাত্মিকতা ও সংগ্রাম
দরূদ পাঠ ও মৌমাছির মধু সংগ্রহ—আধ্যাত্মিক সাধনা ও শ্রমের সমান্তরাল চিত্র।
পরাবাস্তবতার সার্থকতা
এই কবিতায় পরাবাস্তবতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট—
-
বাস্তব ও অবাস্তবের মিশ্রণ: মৌমাছি ও দরূদের সাথে জীন ও স্বর্গদূতের সহাবস্থান।
-
স্বপ্নময় দৃশ্যান্তর: এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে লাফিয়ে যাওয়া, যা যুক্তিগতভাবে অসংলগ্ন হলেও আবহে সঙ্গতিপূর্ণ।
-
প্রতীকী অস্পষ্টতা: মধু, বিষ, দোলনা—এসবের অর্থ নির্দিষ্ট নয়, পাঠকের ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল।
সার্বিক মূল্যায়ন
"একটি দোলনা দুলতে থাকে" একটি সফল পরাবাস্তব কবিতা, কারণ এটি—
-
পাঠককে বাস্তবের সীমানা ছাড়িয়ে স্বপ্ন ও অবচেতনের জগতে নিয়ে যায়।
-
প্রতীক ও ইমেজের মাধ্যমে বহুমাত্রিক অর্থস্তর সৃষ্টি করে।
-
দ্বৈততার মাধ্যমে জীবনের জটিল সত্য তুলে ধরে।
এখানে কবি জীবনের মধুরতার সাথে লুকানো বিষ, সৌন্দর্যের সাথে ক্ষয়, পবিত্রতার সাথে অশুভ—এই সবকিছুর সহাবস্থানকে পরাবাস্তব চিত্রমালার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত, দোলনা যেমন শুদ্ধ ও ভুলের মাঝখানে দুলতে থাকে, তেমনি মানুষের জীবনও সুখ ও দুঃখ, আলো ও অন্ধকারের দোলনায় অবিরাম দুলতে থাকে।
No comments:
Post a Comment