কবিতা ও প্রবন্ধ: শরতের কাশফুল – শাহাদাতুর রহমান সোহেল

 

শরতের কাশফুল
– শাহাদাতুর রহমান সোহেল

শরতের কাশফুল কি একান্ত বাংলার ফুল?
শরতে বাংলার আকাশে যেমন সাদা মেঘের
নিত্য আনাগোনা তেমনই বাংলার প্রান্তর জুড়ে
সাদা কাশফুল; মাঠ-ঘাট-নদী তীর
বহুস্থান জুড়ে ফুটে থাকে অজস্র কাশফুল,
কখনো কখনো পরিত্যক্ত কোন প্রাসাদের
উপরেও দেখেছি এফুলের আসর জমাতে –
রাজধানীর মুগদা হয়ে মান্ডার শেষে
আরো এগুলে বিশাল কাশবন;
সেখানে জীবনে প্রথম কোন কাশবনে
আমি ঘুরে বেড়িয়েছি অপার আনন্দে।

ধলেশ্বরীর তীরে প্রচুর কাশফুল;
এর তীরে মুন্সিগঞ্জের ভুঁইয়া বাড়ীর
ছেলে আমার বাবা বললেন –
ধলেশ্বরীর তীরে যেখানে অনেক কাশবন
দেওয়ান বাড়ীতে আমার নানা বাড়ী,
আমার রকিব নামের এক মামা শেষবার
আমাকে এই বাড়ীতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল’
পঁচানব্বই বছর বয়সে বাবার স্মৃতিচারণ;
শত শত হাজার বছরের স্মৃতিময় কাশফুল।

শিবচরের আঁরিয়াল খাঁ নদের পারে গেলে
দেখতে পাবে অজস্র কাশফুল, এর পশ্চিম
পার দত্তপাড়ায় আছে মাইল মাইল কাশবন,
পূর্বপারে সন্ন্যাসী চরেও আছে বড় কাশবন,
মনে হয় রূপকথার রাজ্য, পরীরা উড়ে
বেড়ালে হয়ে যেত পুরো ফ্যান্টাসী।

সুনামগঞ্জের সীমান্ত উপজেলা দোয়ারাবাজারে
মরাচেলা নদীর মোহনায় মেঘালয় পাহাড়ের ছায়ায়
ডানা মেলে থাকে শত সহস্র কাশফুল,
যখন দখিনা হাওয়ায় দোল খায়
তখন বিস্তৃত বালুচর ও নদী হয়ে
উঠে অপূর্ব মোহময় সাদা পরীদের দেশ।

শরতে যমুনার নদীর শিবালয় চর হয়ে
উঠে কাশফুলে সাদা, এর গাছ চরবাসীর
জন্য প্রিয় আকাঙ্খিত জ্বালানীঃ
কাশবন কেটে কেটে বড় বড় আঁটি বেঁধে
কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দর্শনীয়,
ফুলের উৎসব হয়ে যায় আগুনের উৎস,
পুরো শরৎ পেরিয়ে কার্তিকে কাশবন
মরে গেলে চরে শুরু হয় চাষবাস।

তুমি যদি স্বদেশী অথবা বিদেশী বন্ধু হও,
বাংলার প্রান্তর ঘুরে ঘুরে দেখতে পাবে
শরতে অনেক কাশবন, সেখানে তুমি পাবে
অপার আনন্দ ও বিস্ময়ের সন্ধান –
আকাশে সাদা মেঘ, জমিনে সাদা কাশফুল।

Comments on Social Media
আপনার কবিতা পড়তে গিয়ে সত্যিই মনে হলো আমি যেন শরতের কাশবনে হেঁটে যাচ্ছি—আকাশে সাদা মেঘ, জমিনে দুলছে অসংখ্য কাশফুল। কাশফুল শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং চরবাসীর জীবিকার অংশ (জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার)—এই দিকটি উল্লেখ করায় বর্ণনা আরও বাস্তবধর্মী হয়েছে।
- কবি প্রিথুলা জামান

আমি ভুঁইয়া, আপনিও ভুঁইয়া। আমার বাড়ীও মুন্সীগঞ্জ। আপনার কবিতার বাবার স্মৃতির অংশ বেশী হৃদয়গ্রাহী। পুরো কবিতাটাই ভালো।
আবু সাইদ ভুঁইয়া

wow, so nice
কবি মোঃ আবু মুনিফ আল মুকিম


শরতের কাশফুল: নিসর্গ, স্মৃতি ও শৈলীর বহুমাত্রিক পাঠ
- আবু নাবিল 

বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি দীর্ঘকাল ধরে একটি প্রধান অনুষঙ্গ। বিশেষ করে ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে শরৎ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে কবিদের কাব্যচেতনায় স্থান করে নিয়েছে। শরতের আকাশে সাদা মেঘ, নদীর তীর জুড়ে কাশফুল, কিংবা শিউলির সৌরভ—এসবই বাঙালি জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। কবি শাহাদাতুর রহমান সোহেল রচিত “শরতের কাশফুল” কবিতাটি এই চিরচেনা নিসর্গকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি নিসর্গচিত্রময় কবিতা হলেও, গভীরভাবে পাঠ করলে ধরা পড়ে—এখানে প্রকৃতি, স্মৃতি, ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার এক সুসমন্বিত প্রতিফলন রয়েছে। এই প্রবন্ধে কবিতার বিষয়বস্তু, শৈলী, চিত্রকল্প এবং প্রতীকের আলোকে এর বহুমাত্রিক পাঠ উপস্থাপন করা হবে।

বাংলার ভূচিত্র ও কাশফুলের বিস্তার

কবিতার শুরুতেই কবি একটি দার্শনিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন— "শরতের কাশফুল কি একান্ত বাংলার ফুল?" এই প্রশ্নের উত্তর তিনি সরাসরি না দিয়ে পাঠককে বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরিয়ে নিয়ে চলেন। রাজধানীর মুগদা থেকে শুরু করে ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, যমুনা এবং সুনামগঞ্জের মরাচেলা নদীর মোহনা পর্যন্ত তাঁর এই কাব্যিক যাত্রা বিস্তৃত। এই ভৌগোলিক উল্লেখগুলো কবিতাকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। কাশফুল এখানে কোনো কল্পনার ফুল নয়, বরং বাংলাদেশের মাটিতে ফুটে থাকা এক জীবন্ত বাস্তবতা। কবি দেখিয়েছেন, কাশফুল শুধু নদীর তীরেই নয়, "পরিত্যক্ত কোন প্রাসাদের উপরেও" আসর জমায়। এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে ফুলটির সর্বব্যাপী উপস্থিতি এবং জীবনের জয়গানই ফুটে ওঠে।

স্মৃতি ও শিকড়ের সন্ধান

কবিতার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী এবং শক্তিশালী অংশ হলো কবির ব্যক্তিগত স্মৃতির অবতারণা। ধলেশ্বরীর তীরে গিয়ে তাঁর পঁচানব্বই বছর বয়সী বাবার স্মৃতিচারণ কবিতাটিকে এক ভিন্ন মাত্রা দেয়। বাবার কণ্ঠে যখন আমরা শুনি, "দেওয়ান বাড়ীতে আমার নানা বাড়ী, আমার রকিব নামের এক মামা শেষবার আমাকে এই বাড়ীতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল"—তখন কাশফুল আর কেবল একটি ফুল থাকে না, হয়ে ওঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা স্মৃতির ধারক। কবির ভাষায়, "শত শত হাজার বছরের স্মৃতিময় কাশফুল"। এই একটি লাইনেই কাশফুলের সাথে বাঙালির হাজার বছরের আত্মিক সম্পর্ক উন্মোচিত হয়। ফুলটির ক্ষনস্থায়ী সৌন্দর্যের পেছনে যে এক শ্বাশ্বত ইতিহাস ও পারিবারিক বন্ধনের গল্প লুকিয়ে আছে, কবি তা দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন।

সৌন্দর্য ও বাস্তবতার দ্বৈত প্রতিচ্ছবি

শাহাদাতুর রহমান সোহেলের এই কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব হলো এটি কাশফুলের রোমান্টিকতাকে যেমন ধারণ করেছে, তেমনি এর পেছনের কঠোর বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করেনি। আড়িয়াল খাঁ বা সুনামগঞ্জের কাশবনকে তাঁর কাছে "রূপকথার রাজ্য" বা "সাদা পরীদের দেশ" বলে মনে হয়েছে। কিন্তু যমুনার চরে গিয়ে আমরা এক ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই।
কবির শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ফুটে ওঠে যখন তিনি লেখেন:

"ফুলের উৎসব হয়ে যায় আগুনের উৎস"

যে কাশফুলের সৌন্দর্য দেখে মন আনন্দে ভরে যায়, সেই কাশবনই চরের দরিদ্র মানুষের কাছে মহামূল্যবান জ্বালানি। সৌন্দর্য এখানে জীবনের প্রয়োজনে রূপান্তরিত হয়। কাঁধে করে কাশের আঁটি বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি কেবল একটি ছবি নয়, এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক নিরেট বাস্তবতা। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কবি রোমান্টিকতা এবং বাস্তবতার এক অসাধারণ ভারসাম্য তৈরি করেছেন, যা কবিতাটিকে আরও বেশি মানবিক ও পূর্ণাঙ্গ করে তুলেছে।

৪. কবিতার শৈলী ও গঠন

“শরতের কাশফুল” মূলত গদ্যছন্দে রচিত, যা আধুনিক বাংলা কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য।

  • গঠন: কবিতাটি ছয়টি স্তবকে বিভক্ত, প্রতিটি স্তবক একটি ভৌগোলিক স্থান বা স্মৃতিকে কেন্দ্র করে নির্মিত। এতে ভ্রমণকাহিনীর মতো একটি ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে।

  • ভাষা: ভাষা সহজ, সরল এবং দৈনন্দিন জীবনের কাছাকাছি। যেমন—“মাঠ-ঘাট-নদী তীর”, “পরীরা উড়ে” ইত্যাদি।

  • চিত্রকল্প: “আকাশে সাদা মেঘ, জমিনে সাদা কাশফুল”—এই চিত্র আকাশ ও পৃথিবীর এক সুরেলা সমান্তরালতা তৈরি করে।

  • প্রতীক: কাশফুলকে একদিকে সৌন্দর্যের প্রতীক, অন্যদিকে স্মৃতি ও বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই শৈলী কবিতাটিকে একইসাথে নান্দনিক ও বিশ্লেষণযোগ্য করে তুলেছে।

৫. থিম্যাটিক পর্যালোচনা

কবিতার কেন্দ্রীয় থিমগুলোকে নিম্নরূপে চিহ্নিত করা যায়—

  1. প্রকৃতি ও ভূগোল: কাশফুলের বিস্তার দিয়ে বাংলাদেশের প্রান্তরকে তুলে ধরা।

  2. স্মৃতি ও ঐতিহ্য: পারিবারিক অভিজ্ঞতা ও প্রজন্মান্তরের সম্পর্ককে কাশফুলের প্রতীকে ধারণ।

  3. রোমান্টিকতা ও বাস্তবতা: সৌন্দর্যের সাথে জীবনসংগ্রামের সমান্তরাল উপস্থিতি।

  4. সাংস্কৃতিক পরিচয়: কাশফুলকে কেন্দ্র করে বাংলার শরৎ ও বাঙালি সত্তার নির্মাণ।

উপসংহার:
শাহাদাতুর রহমান সোহেলের “শরতের কাশফুল” কবিতা নিছক প্রকৃতিচিত্র নয়; বরং এটি বাংলার ভূগোল, ইতিহাস, স্মৃতি ও সামাজিক বাস্তবতার এক সমন্বিত প্রতিফলন। গদ্যছন্দের সরলতায় রচিত হলেও কবিতার ভেতরে নিহিত রয়েছে গভীর প্রতীকী শক্তি। কাশফুল এখানে হয়ে উঠেছে একইসাথে নিসর্গের নান্দনিকতা, পারিবারিক স্মৃতির ধারক এবং গ্রামীণ জীবনের উপযোগী সম্পদ। অতএব, কবিতাটি শুধু শরতের ঋতুকে নয়, সমগ্র বাঙালি আত্মপরিচয়কে অনন্যভাবে উপস্থাপন করে। এটি প্রমাণ করে যে, সাধারণের মধ্যেও নিহিত থাকে অসাধারণের সন্ধান।


No comments:

Post a Comment